উদ্ভাবন
পাঁচ দশক আগে বিশ্ব বাণিজ্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল যে প্রযুক্তি
-
আপলোড সময় :
২৬-০৬-২০২৫ ০২:৩৫:২৩ অপরাহ্ন
-
আপডেট সময় :
২৬-০৬-২০২৫ ০২:৩৫:২৩ অপরাহ্ন
প্রতিকী ছবি। ( গ্রাফিক্স )
মানুষের আঙুলের ছাপ যেমন একে অপরের থেকে আলাদা, ঠিক তেমনি প্রতিটি প্যাকেটজাত পণ্যের স্বতন্ত্র পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য জন্ম নেয় এক অসাধারণ প্রযুক্তি—বারকোড। এটি স্ক্যান করার সঙ্গে সঙ্গেই পণ্যের সকল তথ্য এক মুহূর্তে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ১৯৭৪ সালের ২৬ জুন, যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ট্রয় শহরের মার্শ সুপারমার্কেটের ক্যাশ রেজিস্টারে প্রথমবারের মতো এই অনন্য উদ্ভাবন ব্যবহৃত হয়। সেই দিন একটি রিগলি কোম্পানির জুসিফ্রুট চুইংগাম স্ক্যান করার মধ্য দিয়ে বিশ্ব সাক্ষী হয় অটোমেটেড রিটেইল প্রযুক্তির এক যুগান্তকারী সূচনার।
বর্তমানে, একবিংশ শতাব্দীতে বারকোড প্রতিটি পণ্যের অবিচ্ছেদ্য পরিচয়চিহ্ন হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এটি বিশ্বব্যাপী পণ্যের গতিবিধি ও মজুত ব্যবস্থাপনার এক অব্যর্থ হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। তবে বিস্ময়কর হলো, এই নিঃশব্দ প্রযুক্তি বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল মোর্স কোডের অনুপ্রেরণায়, এমন একটি উদ্যোগ হিসেবে যা প্রাথমিক অবস্থায় শিল্পমহলের কাছ থেকে তেমন স্বীকৃতি পায়নি।
আবিষ্কারের পেছনের মানুষ ও প্রক্রিয়া
বারকোড প্রযুক্তির জন্ম হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার ড্রেক্সেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির দুই ছাত্র—বার্নার্ড সিলভার ও নরম্যান জোসেফ উডল্যান্ডের হাত ধরে। ১৯৪৮ সালে স্থানীয় একটি গ্রোসারি চেইনের সভাপতির অনুরোধে তারা এমন একটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির পরিকল্পনা করেন যা পণ্যের দ্রুত শনাক্তকরণে সহায়তা করবে।
প্রথম দিকে তারা অতিবেগুনী কালি ও বিভিন্ন অপটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষা চালান। পরে, উডল্যান্ডের মাথায় আসে মোর্স কোডের মত প্যাটার্ন ব্যবহার করার চিন্তা। এই কোডকে একটি গোল আকৃতিতে উপস্থাপন করে তৈরি হয় প্রথম প্রোটোটাইপ—যাকে তিনি বালির উপর স্কেচ করেছিলেন।
১৯৫২ সালে তারা পেটেন্ট নেন ‘Classifying Apparatus and Method’ নামে একটি পদ্ধতির উপর। তবে সেই প্রযুক্তি বাস্তবায়নযোগ্য হয়ে ওঠে অনেক পরে। মূলত, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং রিটেইল শিল্পের অস্বস্তি—এই দুইয়ের কারণে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বারকোড বাণিজ্যিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি।
প্রযুক্তিগত পরিপক্বতা ও বাস্তবায়নের ইতিহাস
বারকোড প্রযুক্তি পরিপক্ব হয়ে ওঠে মূলত ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে। সেসময় ডেভিড জে. কলিন্স নামে এক ইঞ্জিনিয়ার রেলগাড়ির সনাক্তকরণ ব্যবস্থায় রঙিন প্যাটার্ন ব্যবহার করে পরীক্ষা চালান। এই প্রযুক্তিকে ধরা হয়েছিল বারকোড স্ক্যানিংয়ের ভিত্তি হিসেবে।
১৯৭৩ সালে আইবিএম ইঞ্জিনিয়ার জর্জ লরর ইউনিভার্সাল প্রোডাক্ট কোড (UPC) নামে একটি স্কিম তৈরি করেন, যেটি পরে ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই কোড ব্যবহার করে উৎপাদক ও খুচরা বিক্রেতারা পণ্যের ধরণ, গুণমান ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য আদান-প্রদান করতে পারেন।
১৯৭৪ সালের ২৬ জুন, ওহাইও'র ট্রয় শহরে অবস্থিত মার্শ সুপারমার্কেটের চেকআউট কাউন্টারে প্রথমবারের মতো এই UPC কোড ব্যবহার করে স্ক্যান করা হয় একটি চুইংগামের প্যাকেট। সেই ঘটনা ছিল কার্যত এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা খুচরা বাণিজ্যের ইতিহাস বদলে দেয়।
শুরুতে বাধা, পরে স্বীকৃতি
বারকোড প্রযুক্তি শুরুতে বিভিন্ন খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। অনেকেই পণ্যের গায়ে স্থায়ীভাবে বারকোড ছাপানোর খরচ নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। ক্যান প্রস্ততকারক ও প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রির পক্ষ থেকেও এসেছিল নানান আপত্তি।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রযুক্তির সুবিধাগুলো সামনে আসে। ক্যাশ কাউন্টার প্রক্রিয়া দ্রুত হয়, ইনভেন্টরি ট্র্যাকিং সহজ হয়, বিক্রয় পরিসংখ্যান রক্ষণাবেক্ষণে নির্ভুলতা আসে, এমনকি গ্রাহক সন্তুষ্টিও বাড়ে। ১৯৮০’র দশক নাগাদ বেশিরভাগ বড় খুচরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এই প্রযুক্তি গ্রহণ করে।
বারকোডের বিবর্তন: রৈখিক থেকে দ্বিমাত্রিক
প্রাথমিকভাবে বারকোড ছিল একমাত্রিক বা রৈখিক—সমান্তরাল কালো-সাদা দাগের মাধ্যমে তথ্য ধারণকারী। এই তথ্য সাধারণত কোড স্ক্যান করে কম্পিউটার সফটওয়্যারে পাঠানো হতো। তবে প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে দ্বিমাত্রিক ম্যাট্রিক্স কোড—যেমন কিউআর কোড।
QR কোডে একই জায়গায় অধিকতর তথ্য রাখা সম্ভব এবং তা বিভিন্ন দিক থেকে স্ক্যান করা যায়। আজকাল কিউআর কোড ব্যবহার হচ্ছে ওয়েবসাইট অ্যাক্সেস, ডিজিটাল পেমেন্ট, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের সত্যতা যাচাইসহ নানা ক্ষেত্রে।
ব্যবহারের বহুবিধতা
বারকোড ব্যবহারের সীমা এখন শুধু সুপারমার্কেটে আটকে নেই। বিমানবন্দরে লাগেজ ট্র্যাকিং, ওষুধের বোতলের নিরাপত্তা যাচাই, মুভি টিকেট যাচাইকরণ, হাসপাতালের রোগী পরিচিতি ব্যবস্থাপনা, লাইব্রেরি বুক ট্র্যাকিং—প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এর প্রয়োগ বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বারকোড প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, খরচে সাশ্রয় ও দ্রুত প্রসেসিং সময় একে অন্যান্য প্রযুক্তির চেয়ে এগিয়ে রেখেছে। যদিও রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (RFID) ও ব্লুটুথ ভিত্তিক কিছু আধুনিক বিকল্প বাজারে এসেছে, তবু বারকোডের মত সর্বজনগ্রাহ্য প্রযুক্তি তারা হয়ে উঠতে পারেনি।
বারকোড নিয়ে বিতর্ক
বারকোডের আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। উডল্যান্ড ও সিলভারকে সাধারণত এর উদ্ভাবক হিসেবে ধরা হলেও, পরবর্তীতে বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
ডেভিড কলিন্সের স্ক্যানিং প্রযুক্তি, জর্জ লররের ডিজাইন, আইবিএম ও আরসিএর অবকাঠামোগত বিনিয়োগ—সবই এই প্রযুক্তিকে বাস্তবতায় রূপ দিতে সহায়ক হয়।
বারকোড ও বিশ্বব্যবসা
বারকোডকে একটি নিঃশব্দ বিপ্লব বলা হয়, কারণ এটি বাজারে বিশাল পরিবর্তন এনেছে তেমন কোনো ঘোষণা বা প্রচার ছাড়াই। বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন কয়েক বিলিয়ন বার পণ্য স্ক্যান হয় বারকোডের মাধ্যমে। এটি বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনকে নির্ভুল ও দক্ষ করতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে বারকোড প্রযুক্তি স্থানীয় উৎপাদকদের পণ্য বিশ্ববাজারে নিতে সহায়তা করছে। আজকে বিশ্বজুড়ে কোন পণ্য কোথায় গেছে, কত বিক্রি হয়েছে, কী দামে বিক্রি হয়েছে—সবই জানা যাচ্ছে এই ক্ষুদ্র রেখার মাধ্যমে।
প্রতীকী গুরুত্ব ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা
২০১৯ সালে নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে বারকোড প্রযুক্তিকে ‘আধুনিক বিশ্বের নিরব সহচর’ আখ্যা দিয়েছিল। বিশ্বের নানা জাদুঘরে আজ সংরক্ষিত আছে ১৯৭৪ সালের সেই চুইংগামের রেপ্লিকা। স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামে রাখা আছে সেই ঐতিহাসিক স্ক্যানিং মেশিনটিও।
প্রতিটি পণ্যে বারকোডের ব্যবহার দোকানে দ্রুত ও নির্ভুল বিলিং নিশ্চিত করে গ্রাহকদের সময় বাঁচায়। এর মাধ্যমে ইনভেন্টরি বা মজুত ব্যবস্থাপনা সহজ হয়, ফলে পণ্যের ঘাটতি বা অতিরিক্ত মজুত এড়ানো যায় এবং খরচ কমে। বারকোড বিক্রয় ডেটা বিশ্লেষণ করে ব্যবসায়ের কৌশল নির্ধারণে সহায়তা করে এবং পণ্যের উৎস থেকে গ্রাহক পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ ট্র্যাক করতে সাহায্য করে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হওয়ায় এটি বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য সহজ করে তুলেছে। সব মিলিয়ে, বারকোড আধুনিক ব্যবসা ও সাপ্লাই চেইনকে দক্ষ ও ত্রুটিমুক্ত রাখতে অপরিহার্য।
বারকোডের ভবিষ্যৎ এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট অব থিংস (IoT)-এর সঙ্গে আরও বেশি সংযুক্ত হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো বারকোড থাকবে দৃশ্যমান নয়, কিন্তু তার কাজ করবে আরও নিখুঁতভাবে।
তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস; AccuGraphiX / History of Bar Codes
নিউজটি আপডেট করেছেন : নিজস্ব প্রতিবেদক
কমেন্ট বক্স