, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫ , ১৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
​জলবায়ু সংকটে সমুদ্র

পৃথিবীর স্থলভাগের দিকে ধেয়ে আসছে ভয়ংকর সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ

  • আপলোড সময় : ২২-০৬-২০২৫ ১২:২৩:৩৬ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২২-০৬-২০২৫ ১২:৩৮:১৫ অপরাহ্ন
পৃথিবীর স্থলভাগের দিকে ধেয়ে আসছে ভয়ংকর সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ ছবি- এ আই

বিশ্বের সামুদ্রিক পরিবেশে এক গভীর পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ বা মেরিন হিট ওয়েভ। কয়েক দশক আগেও এমন ঘটনা ছিল তুলনামূলকভাবে বিরল। কিন্তু এখন এসব তাপপ্রবাহ এতটাই ঘন ঘন এবং ব্যাপকভাবে ঘটছে যে বিজ্ঞানীরা এগুলোর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই “সুপার মেরিন হিট ওয়েভ” নামে নতুন একটি পরিভাষা প্রয়োগ করছেন। বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের কারণে পৃথিবীর জলবায়ু যেমন পাল্টে যাচ্ছে, তেমনি সমুদ্রের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রাও বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই উষ্ণতার ঢেউ শুধু সামুদ্রিক পরিবেশেই নয়, প্রভাব ফেলছে আবহাওয়ার চক্র, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এবং অর্থনীতির উপরও। মৎস্য, সামুদ্রিক জীবন এবং উপকূলীয় সমাজের অস্তিত্বই এখন চ্যালেঞ্জের মুখে।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এক রিপোর্টে দেখা যায়, বিশ্বের সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় ৪০ শতাংশ অঞ্চল একযোগে তাপপ্রবাহের কবলে পড়ে। যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডের উপকূলবর্তী সাগরে রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির নজির পাওয়া গেছে; ঘটনাটি ঘটে বছরের একেবারে শুরুতে, যা পূর্ববর্তী সময়ে ছিল নজিরবিহীন।

https://www.nytimes.com/2025/06/09/climate/see-how-marine-heat-waves-are-spreading-across-the-globe.html?smid=url-share

জাতীয় মহাসাগর ও বায়ুমণ্ডল বিষয়ক প্রশাসনের (NOAA) ওশেনোগ্রাফার বয়িন হুয়াং জানান, “এই তাপপ্রবাহ যেসব সামুদ্রিক অঞ্চলে দেখা দিয়েছে, সেসব অঞ্চলে অতীতে কখনো এমন উচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়নি।”

এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার দুই উপকূলজুড়ে সম্প্রতি একাধিক তাপপ্রবাহে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিখ্যাত প্রবালপ্রাচীর অঞ্চল। প্রবাল যখন অতিরিক্ত গরম পানিতে পড়ে, তখন তারা রঙ হারিয়ে সাদা হয়ে যায়, একে বলে ব্লিচিং। এবং এর ফলে ধীরে ধীরে প্রবাল মৃত হয়ে যায়। জানুয়ারি ২০২৩ থেকে মার্চ ২০২৫ সময়কালে বিশ্বের প্রায় ৮৪ শতাংশ প্রবালপ্রাচীর ব্লিচিং পর্যায়ের উষ্ণতার শিকার হয়েছে।

সমুদ্র উষ্ণ হওয়ার আরেকটি প্রধান প্রভাব হচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। বিজ্ঞানীরা এতদিন ধরে বিশ্বাস করতেন, গলতে থাকা হিমবাহ এবং বরফচাদরের কারণে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে। তবে ২০২৪ সালে দেখা গেছে, অধিকাংশ উচ্চতা বৃদ্ধির কারণ ছিল ‘থার্মাল এক্সপ্যানশন’ বা তাপের কারণে পানির আয়তন বেড়ে যাওয়া।

এর প্রভাব কেবল সামুদ্রিক জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, প্রভাব পড়ছে মানবিক দুর্যোগেও। সমুদ্রের বাড়তি তাপ ঘূর্ণিঝড়ের গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের আরও ধ্বংসাত্মক করে তুলছে। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে ২০২৪ সালে তাপপ্রবাহের কারণে ফিলিপাইনের উপরে পরপর বেশ কয়েকটি ট্রপিক্যাল সাইক্লোন আঘাত হানে, যা ছিল রেকর্ড সংখ্যক।

স্পেনের বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী মার্তা মার্কোস বলেন, “যদি আমরা বুঝতে পারি যে জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে এসব চরম ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাহলে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারব।”

তার নেতৃত্বে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, গত কয়েক দশকের সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের জন্য প্রায় সম্পূর্ণভাবেই দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন।

এতসব ঘটনার মাঝে সবচেয়ে নজরকাড়া উদাহরণগুলোর একটি হচ্ছে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের “দ্য ব্লব” নামের তাপপ্রবাহ, যা ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এটি সমুদ্রের পৃষ্ঠের স্বাভাবিক প্রবাহকে রুদ্ধ করে দিয়ে খাদ্যচক্রের গোড়া থেকেই বিচ্যুতি ঘটায়—ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন কমে যায়, তার সাথে সাথে কমে যায় মাছ, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী ও পাখিদের খাবার।

এর প্রভাবে লাখ লাখ সামুদ্রিক পাখি অনাহারে মারা যায়। হাজার হাজার হাম্পব্যাক তিমি হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায় বা দুর্বল হয়ে পড়তে দেখা যায়। অ্যালাস্কার গ্লেসিয়ার বে’র কাছে ২০১৬ সালে এক মৃত হাম্পব্যাক তিমি পাওয়া যায়, যার শরীরে অপুষ্টি ও বিষাক্ত অ্যালগাল টক্সিনের উপস্থিতি ধরা পড়ে।

হ্যাপিওয়েইল নামে একটি সংগঠন বিশাল ডেটাবেস তৈরির মাধ্যমে তিমির জনসংখ্যার উপর গবেষণা চালায় এবং ২০১২ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে হাম্পব্যাক তিমির সংখ্যা ২০ শতাংশ কমে যাওয়ার তথ্য প্রকাশ করে।

এই সংকট শুধু বড় প্রজাতির উপরেই নয়, আঘাত হানে ক্ষুদ্র প্রাণীতেও। ২০১২ সালে গালফ অফ মেইনে এক তাপপ্রবাহের কারণে নর্থার্ন শ্রিম্প প্রজাতির সংখ্যা ২৭ বিলিয়ন থেকে ২.৮ বিলিয়নে নেমে আসে। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা আরও কমে প্রায় ২০০ মিলিয়নে এসে দাঁড়ায়।

উত্তর মেরিন গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বিজ্ঞানী ক্যাথি মিলস বলেন, “মৎস্যজীবীদের জন্য কাজ করাই সবসময় কঠিন, কিন্তু এখন জলবায়ু পরিবর্তন এটিকে আরেক মাত্রায় নিয়ে গেছে।”

এমন সংকট অনেক সময় গবেষণার সীমাবদ্ধতায় অজানাই থেকে যায়। গবেষণাগুলো বেশিরভাগই হয় অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কানাডা, স্পেন ও যুক্তরাজ্যে। কিন্তু আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার অনেক সামুদ্রিক অঞ্চলেই তেমন নজরদারি নেই।

ইউনাইটেড কিংডমের মেরিন বায়োলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ইকোলজিস্ট ড্যান স্মেইল বলেন, “অনেক অঞ্চলের তথ্যই আমাদের হাতে নেই, ফলে কী ঘটছে তা আমরা জানতেও পারি না।”

২০২৩ সালের শেষ দিকে, তাসমানিয়া উপকূলে বসবাসকারী একটি বিরল প্রজাতি — রেড হ্যান্ডফিশ — নিয়ে এক সংকটময় পরিস্থিতি দেখা দেয়। অস্ট্রেলিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর আগাম পূর্বাভাসে জানানো হয়, তাপমাত্রা প্রাণঘাতী পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। তখন তাসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ঝুঁকি কমাতে ২৫টি রেড হ্যান্ডফিশকে অ্যাকুয়ারিয়ামে স্থানান্তর করেন। প্রায় তিন মাস পর, ১৮টি মাছ নিরাপদে সমুদ্রে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, আর তিনটি মারা যায়, চারটি রাখা হয় প্রজনন গবেষণার জন্য।

এমন ঘটনা প্রমাণ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পথ খুঁজতে গেলে শুধু প্রতিক্রিয়াশীল নয়, পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশনের বায়োলজিকাল ওশেনোগ্রাফার অ্যালিস্টার হবডে বলেন, “চতুর মানুষদের যদি আপনি ভবিষ্যৎ দেখাতে পারেন, তাহলে তারা অনেক কিছুর পরিবর্তন করতে পারে।”
বিজ্ঞানীরা জানেন, এসব সাময়িক সমাধান দীর্ঘমেয়াদে যথেষ্ট নয়। সামুদ্রিক উষ্ণতা এখনো কমানোর কার্যকর পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী গ্রহণ করা হয়নি। একদিকে বৈশ্বিকভাবে হ্রাস পায়নি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, অন্যদিকে কার্বন নিঃসরণ বেড়েই চলেছে।

বিগত কয়েক দশকে মহাসাগরের বিশাল পরিমাণ তাপ শোষণের কারণে পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। এখন সময় এসেছে গভীর ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই সংকট মোকাবিলায় বাস্তবভিত্তিক ও সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার। কারণ এই সংকট আর কেবল পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি মানবিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও এক জটিল বাস্তবতা হয়ে উঠছে।
 
সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস
 

নিউজটি আপডেট করেছেন : নিজস্ব প্রতিবেদক

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
​‘এনবিআর সংস্কার’ বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর বার্তা

​‘এনবিআর সংস্কার’ বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর বার্তা