চারদিন ধরে চলমান তীব্র বিমানযুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ইরান। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি এক্সে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য করতে ওয়াশিংটনের একটি ফোনকলই যথেষ্ট। তিনি উল্লেখ করেন, “যদি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সত্যিই কূটনীতির পক্ষে থাকেন এবং এই যুদ্ধ থামাতে চান, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই আহ্বান কাতার, সৌদি আরব ও ওমানের মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে পৌঁছানো হয়েছে। বিনিময়ে তেহরান পরমাণু আলোচনায় নমনীয়তা প্রদর্শনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
এদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সোমবার ইজরাইলি সেনাবাহিনীর বিমানঘাঁটিতে দেওয়া বক্তব্যে বলেন, “আমরা জয়ের পথে। আমরা ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করতে এবং তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা নির্মূল করতে সফল হচ্ছি।”
ইসরায়েল শুক্রবার ইরানে বিমান হামলা শুরু করার পর থেকে দু’দেশের মধ্যে রুদ্ধশ্বাস যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। এই হামলায় ইরানের সামরিক নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা এবং পরমাণু কর্মসূচির মূল বিজ্ঞানীরা নিহত হন বলে ইসরায়েল দাবি করেছে। তারা আরও বলছে, ইরানের আকাশসীমা তাদের নিয়ন্ত্রণে এবং সামনে হামলা আরও জোরদার হবে।
এই প্রেক্ষাপটে ইরান যে পাল্টা হামলা চালিয়েছে, তা দেশটির ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী ও সংঘাতপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে। তেহরান দাবি করেছে, এই হামলায় ইসরায়েলের ৩৭ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে এবং বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে।
ইরানে ইতোমধ্যে ২২৪ জনের বেশি নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী, শিশু ও বয়স্ক বেসামরিক মানুষ বলে ইরানি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন প্রচার করেছে। সংবাদমাধ্যমে তেহরানের ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তাঘাট, প্রেসিডেন্সিয়াল ভবন, পোড়া গাড়ি এবং আতঙ্কিত বাসিন্দাদের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ হয়েছে। শহর ছাড়তে শুরু করেছেন বহু বাসিন্দা। পেট্রোল স্টেশন ও এটিএম বুথে দীর্ঘ সারি, অনেক জায়গায় নগদ অর্থ ফুরিয়ে গেছে।
রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তেহরানের সরকারি কর্মচারী গলামরেজা মোহাম্মদি (৪৮) বলেন, “আমি নিরুপায়। আমার দুই সন্তান রাতে ঘুমাতে পারে না—বিমান প্রতিরক্ষা ও বিস্ফোরণের শব্দে। আমরা ডাইনিং টেবিলের নিচে লুকিয়ে থাকি।”
ইসরায়েল জানায়, সোমবার ভোরে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিব ও হাইফায় আঘাত হানে, এতে আটজন নিহত হন এবং বহু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাতে ছোড়া সাতটি ক্ষেপণাস্ত্র আরও প্রায় ১০০ জনকে আহত করেছে। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড দাবি করেছে, তাদের নতুন কৌশল অনুযায়ী ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একে অপরকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে বাধ্য হয়েছে, ফলে আক্রমণ আরও কার্যকর হয়েছে।
এদিকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ এক বিবৃতিতে বলেন, “তেহরানের দাম্ভিক শাসক এখন এক কাপুরুষ খুনি, যিনি বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাচ্ছেন। কিন্তু তেহরানের বাসিন্দারা এর মূল্য দেবে, শিগগিরই।”
অন্যদিকে কূটনৈতিক অচলাবস্থাও প্রকট হচ্ছে। রবিবার ওমানে নির্ধারিত যুক্তরাষ্ট্র-ইরান আলোচনা বাতিল করা হয়েছে। ইরান জানায়, আক্রমণের মুখে তারা আলোচনায় বসতে পারবে না। সোমবার ইরানের সংসদ সদস্যরা এনপিটি (পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি) থেকে সরে আসার প্রস্তাব দেন।
এদিকে তেল ও গ্যাস সরবরাহ নিয়ে বিশ্ববাজার উদ্বিগ্ন। যুদ্ধ শুরুর পর শুক্রবার তেলের দাম বেড়ে যায়, তবে সোমবার তা কিছুটা কমে। অর্থাৎ, ইরানি তেল স্থাপনায় আঘাত সত্ত্বেও বিশ্ববাজার মনে করছে সরবরাহ পুরোপুরি ব্যাহত হবে না।
তেহরানের শিল্পশিক্ষক আর্শিয়া (২৯) রয়টার্সকে বলেন, “আমার পরিবার দমাভান্দে যাচ্ছে, তেহরান থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে। প্রতিদিন রাতে হামলা হয়, কোনো সাইরেন বাজে না, কোনো নিরাপদ আশ্রয়ও নেই। ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শত্রুতামূলক নীতির জন্য কেন আমাদের মূল্য দিতে হবে?”
এই পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। ইরানের মিত্র গাজা ও লেবাননের হামাস ও হিজবুল্লাহ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখন আর তারা বড় হামলার সক্ষমতা রাখছে না বলে জানিয়েছে সামরিক বিশ্লেষকরা। নেতানিয়াহু স্পষ্টভাবে বলেছেন, যদিও ইরান সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য নয়।
সব মিলিয়ে এই যুদ্ধ এখন শুধু ইসরায়েল-ইরানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা ধীরে ধীরে জটিল আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নিচ্ছে। ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ ও কূটনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনার মধ্যেই অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্ব রাজনীতি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : নিজস্ব প্রতিবেদক