
কর্মজীবনের সূচনালগ্নে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণদের স্বপ্নীল চোখে ভবিষ্যতের ছবিটা কেমন? হয়তো স্থিতিশীল একটি চাকরি, একটি আরামদায়ক জীবন, আর নির্দিষ্ট বয়সে নিশ্চিন্ত অবসর। কিন্তু, প্রথাগত এই ধারণার বাইরেও এক ভিন্ন পথ রয়েছে, যেখানে ‘আর্থিক স্বাধীনতা’ নামক এক লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে জীবনের লাগাম নিজের হাতে নেওয়া যায় অনেক আগেই। সম্প্রতি ফোর্বস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত উইলিয়াম আররুডার একটি বিশ্লেষণমূলক লেখা এই তরুণদের জন্য যেন এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এটি কেবল দ্রুত অবসরের একটি চিত্র নয়, বরং নিজের শর্তে, নিজের গতিতে জীবনকে উপভোগ করার এক অনন্য কৌশল।
অনেক নতুন স্নাতক তাদের প্রথম পেশাদার কর্মজীবনে পা রাখছেন। তাদের সামনে এখন নতুন চ্যালেঞ্জ আর অসীম সম্ভাবনা। এই সময়েই যদি আর্থিক স্বাধীনতার বীজ বোনা যায়, তবে ভবিষ্যতের পথ অনেকটাই মসৃণ হয়ে ওঠে। এর জন্য প্রয়োজন কিছু সুনির্দিষ্ট মানসিকতা, আচরণ এবং অভ্যাস গড়ে তোলা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে তরুণদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতা বাড়ছে, সেখানে এই ১৬টি পদক্ষেপ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
১. যোগ্যতার সঠিক মূল্য নির্ধারণ
আপনার প্রথম চাকরির বেতন কাঠামো কেবল একটি সংখ্যা নয়, এটি আপনার ভবিষ্যৎ আয়ের ভিত্তি। কারণ, পরবর্তী বেতন বৃদ্ধি সাধারণত প্রথম বেতনের শতাংশ হিসেবেই নির্ধারিত হয়। তাই, শুরুতেই যদি আলোচনার মাধ্যমে একটি ভালো বেতন নিশ্চিত করা যায়, তবে তা সারা জীবনের উপার্জনকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বেতন নিয়ে আলোচনা কিছুআটা অস্বস্তিকর মনে হলেও, নিজের যোগ্যতা ও বাজারের চাহিদা সম্পর্কে সচেতন থেকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আলোচনা করা অত্যন্ত জরুরি। এটি কেবল বেতন নয়, আপনার কর্মজীবনের মূল্যবোধকেও তুলে ধরে।
২. প্রথম বেতন, প্রথম সঞ্চয়
নতুন চাকরি মানেই নতুন জীবন। আর নতুন জীবন মানেই নতুন অভ্যাস গড়ে তোলার সুবর্ণ সুযোগ। প্রথম বেতন হাতে পাওয়ার পর থেকেই সঞ্চয়কে একটি অবিচ্ছেদ্য অভ্যাসে পরিণত করুন। আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ, ধরা যাক ১০% থেকে ২০%, সরাসরি সঞ্চয় অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করুন। এতে সেই অর্থ আপনার হাতের নাগালের বাইরে থাকবে এবং অপচয়ের সম্ভাবনা কমবে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর স্বয়ংক্রিয় সঞ্চয় প্রকল্পগুলো এই ক্ষেত্রে দারুণ সহায়ক হতে পারে।
৩. বেতন বাড়লেও খরচ নয়
প্রথম বেতন পাওয়ার পর অনেকেই জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে চান। নতুন পোশাক, দামি গ্যাজেট বা বিনোদনমূলক খরচ – এসবের হাতছানি প্রবল। কিন্তু মনে রাখবেন, আয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবনযাত্রার মান বাড়ালে সঞ্চয়ের সুযোগ কমে যায়। বরং, খরচ কম রেখে অতিরিক্ত অর্থ সঞ্চয় করার প্রবণতা আপনাকে দ্রুত আর্থিক স্বাধীনতার পথে এগিয়ে দেবে। ‘নিজের সামর্থ্যের নিচে জীবনযাপন’ করাটা এক ধরনের শিল্প, যা শেখা গেলে ভবিষ্যতের জন্য অনেক বড় তহবিল তৈরি হয়।
৪. এখনকার ছোট বিনিয়োগ, ভবিষ্যতের স্বস্তি
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, তরুণদের জন্য ব্যবসার ক্ষেত্রগুলো হতে পারে এক চমৎকার বিনিয়োগের মাধ্যম, যা ভবিষ্যতের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা গড়ে তোলে। প্রথাগত প্রভিডেন্ট ফান্ড বা পেনশন স্কিমের পাশাপাশি, ছোট আকারের লাভজনক ব্যবসায়িক উদ্যোগে পুঁজি খাটানো যেতে পারে। যেমন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME) বা স্টার্টআপে বিনিয়োগ, অথবা ডিজিটাল ব্যবসার অংশীদার হওয়া। এই ধরনের বিনিয়োগে যত দ্রুত সম্ভব এবং সর্বোচ্চ পরিমাণে অর্থ লাগানো উচিত।
কারণ হলো, আর্থিক প্রবৃদ্ধি বাড়ে দ্রুতগতিতে যখন বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদী হয়। যত আগে আপনি এই ধরনের ব্যবসায় বিনিয়োগ শুরু করবেন, তত বেশি লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এমনকি যদি আপনার কোম্পানি কোনো বিনিয়োগ ম্যাচিংয়ের সুযোগ দেয় (যেমন, কর্মীদের জন্য বিশেষ ব্যবসা তহবিল বা লাভ-বণ্টন স্কিম), সেটিও গ্রহণ করা অত্যন্ত বুদ্ধিমানের কাজ। এই কৌশলগুলো আপনাকে ভবিষ্যতের জন্য একটি মজবুত আর্থিক ভিত্তি তৈরি করতে সাহায্য করবে।
৫. স্বল্প খরচে উচ্চ রিটার্ন
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ফি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আপনার প্রকৃত রিটার্নকে কমিয়ে দেয়। তাই, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কম ফি-যুক্ত বিকল্পগুলো বেছে নেওয়া উচিত। বাংলাদেশের বাজারে সরকারি সঞ্চয়পত্র, বন্ড এবং কিছু নির্দিষ্ট মিউচুয়াল ফান্ড তুলনামূলকভাবে কম ফি-তে ভালো রিটার্ন দিতে পারে। বিনিয়োগের আগে বিভিন্ন ফান্ডের ফি কাঠামো ভালোভাবে যাচাই করে নেওয়া উচিত।
৬. একাধিক আয়ের উৎস তৈরি
কেবল একটি আয়ের উৎসের উপর নির্ভর করে থাকাটা সবসময় নিরাপদ নয়। ফ্রিল্যান্সিং, অনলাইন টিউটরিং, ব্লগিং, ছোট অনলাইন ব্যবসা বা শখের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করা যেতে পারে। এই ‘পলিওয়ার্কিং’ কেবল আপনার আয় বাড়ায় না, বরং নতুন দক্ষতা অর্জন, পেশাদার নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি এবং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে। এটি আর্থিক নিরাপত্তাকে সুদৃঢ় করে এবং অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে একটি শক্তিশালী ব্যাকআপ তৈরি করে।
৭. ঋণ নেয়ার আগে দশবার ভাবুন
ভালো ঋণ (যেমন শিক্ষা ঋণ বা আবাসন ঋণ) যেখানে আপনাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে, সেখানে উচ্চ সুদের ক্রেডিট কার্ড বা অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত ঋণ আপনাকে আর্থিক সংকটে ফেলতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে বেরিয়ে আসার পর প্রথম দিকে অনেকেই ক্রেডিট কার্ড কিংবা কিস্তিতে মোবাইল/ল্যাপটপ কেনায় আকৃষ্ট হন। কিন্তু এই ধরনের উচ্চ সুদের ঋণ আপনাকে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক চাপে ফেলতে পারে। তাই ‘ব্যাড ডেট’ এড়িয়ে চলুন।
৮. সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা
আপনার আয়-ব্যয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখা এবং আপনার মোট সম্পদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। আপনি কতটা খরচ করছেন, কোথায় খরচ করছেন এবং কোথায় সঞ্চয়ের সুযোগ আছে – এসব জানতে পারলে আপনি আপনার আর্থিক অভ্যাস সম্পর্কে সচেতন হতে পারবেন। এক্সেল শীট বা বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে এই হিসাব রাখা যেতে পারে।
৯. সকল সম্পদের সদ্ব্যবহার
আপনার অব্যবহৃত সম্পদকে আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবহার করার কথা ভাবুন। যেমন, ছুটিতে বাইরে গেলে আপনার বাড়ি ভাড়া দিতে পারেন, বা যদি আপনার একটি গাড়ি থাকে যা আপনি খুব কম চালান, সেটি রাইড-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মে ব্যবহার করতে পারেন। নিষ্ক্রিয় সম্পদকে আয়ের উৎসে পরিণত করার এই ধারণাটি আধুনিক শেয়ারিং অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
১০. FIRE দর্শন: উদ্দেশ্যমূলক জীবনের প্রতিচ্ছবি
FIRE অর্থাৎ Financial Independence, Retire Early – এই ধারণাটি এখন বিশ্বজুড়ে তরুণদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। এটি কেবল দ্রুত অবসরের কথা বলে না, বরং একটি উদ্দেশ্যমূলক জীবনযাপনের দর্শনকে তুলে ধরে। এই বিষয়ে বিভিন্ন বই পড়া, অনলাইন কমিউনিটিতে যুক্ত হওয়া বা বিনিয়োগ ক্লাবগুলোতে অংশ নেওয়া আপনাকে এই পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
১১. 'না' বলার অভ্যাস গড়ে তুলুন
‘ফোমো’ (FOMO - Fear of Missing Out) বা বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার মানসিকতা অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচের কারণ হয়। বিলাসবহুল ক্যাফেতে প্রতিদিন আড্ডা দেওয়া, অপ্রয়োজনীয় গ্যাজেট কেনা বা সমাজের চাপ থেকে মুক্তি পেতে ‘না’ বলার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এই ‘না’ বলা আসলে আপনাকে আর্থিক স্বাধীনতার ‘হ্যাঁ’ বলতে সাহায্য করে। প্রতিটি খরচকে ভালোভাবে মূল্যায়ন করা এবং কেবল প্রয়োজনীয় বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে ব্যয় করা আপনাকে মিতব্যয়ী হতে শেখাবে।
১২. ক্যারিয়ার পরিকল্পনায় কৌশলী হোন
শুধুমাত্র বেশি উপার্জনের পেছনে না ছুটে, এমন একটি কর্মজীবন বেছে নিন যা আপনার ব্যক্তিগত আগ্রহ এবং নমনীয়তার সাথে শক্তিশালী আয়ের সম্ভাবনাকে একত্রিত করে। আপনার পেশা যেন কেবল উপার্জনের মাধ্যম না হয়ে আপনার প্যাশন এবং দক্ষতার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। স্টিভেন কভি যেমন বলেছেন, শুধু মই বেয়ে উঠবেন না – নিশ্চিত করুন যে এটি সঠিক দেয়ালের বিরুদ্ধে হেলে আছে।
১৩. বিনিয়োগের ব্যাপারে সক্রিয় থাকুন
আপনার বিনিয়োগ পোর্টফোলিও নিয়মিত পর্যালোচনা করা অত্যন্ত জরুরি। একজন বিশ্বস্ত আর্থিক উপদেষ্টার পরামর্শ নিয়ে ছোটখাটো সমন্বয়ও আপনার বিনিয়োগের কার্যকারিতা বাড়াতে পারে। বিনিয়োগ পর্যালোচনাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে আপনার ক্যালেন্ডারে যুক্ত করুন।
১৪. আজীবন শেখার অভ্যাস গড়ে তুলুন
কর্মজীবনে সফলতার জন্য ক্রমাগত শেখার কোনো বিকল্প নেই। নতুন দক্ষতা অর্জন, শিল্পের প্রবণতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা আপনাকে কর্মক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক রাখবে। এটি একদিকে যেমন ছাঁটাই হওয়ার ঝুঁকি কমাবে, তেমনি যদি অপ্রত্যাশিতভাবে চাকরি হারান, তবে নতুন সুযোগ খুঁজে পেতে আপনার দক্ষতাগুলো সহায়ক হবে।
১৫. পেশাগত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলুন
অধিকাংশ ভালো চাকরিই নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে পাওয়া যায়। একটি শক্তিশালী পেশাদার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা এবং তা নিয়মিত লালন করা আপনার কর্মজীবনের জন্য একটি নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে। যদি কখনো চাকরি হারানোর মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, তবে আপনার নেটওয়ার্কই আপনাকে নতুন সুযোগ খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।
১৬. অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা এড়িয়ে চলুন
কিছু কেনাকাটা আপাতদৃষ্টিতে ছোট মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে আপনার সঞ্চয়কে নীরবে নিঃশেষ করে দেয়। যেমন, একটি গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বছরে অনেক বেশি হতে পারে, অথচ গাড়ি বেশিরভাগ সময়ই পার্ক করা থাকে। গণপরিবহন, রাইড-শেয়ারিং বা কারপুলিংয়ের মতো বিকল্পগুলো বেছে নিয়ে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো উচিত। কেবল যা আপনার সত্যিই প্রয়োজন, সেটাই কিনুন।
অল্প বয়সে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করার স্বপ্ন দেখা অনেকের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয় কেবল তখনই, যখন আপনি সময় থাকতে সিদ্ধান্ত নেন, পরিকল্পনা করেন এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখেন। বাংলাদেশে তরুণ জনসংখ্যা বিশ্বে অন্যতম। এই জনশক্তিকে যদি আর্থিকভাবে সচেতন করা যায়, তাহলে ব্যক্তি পর্যায়ের উন্নতির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিও আরও শক্তিশালী হবে।
তাই কর্মজীবনের শুরুতেই এই ১৬টি কার্যকর অভ্যাস গড়ে তুলুন। বড় অর্থনৈতিক অর্জনের জন্য বড় বেতন নয়, দরকার বড় পরিকল্পনা আর ছোট ছোট সচেতন পদক্ষেপ।
তথ্যসূত্র: উইলিয়াম আররুডা, সিনিয়র কন্ট্রিবিউটর, ফোর্বস