
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও কিছু অনির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের বিষয়ে যে দাবি ছড়ানো হয়েছে, তা সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। প্রেস উইং এক বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে জানায় যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এমন কোনো পদক্ষেপ বা পরিকল্পনার সাথে সম্পৃক্ত নয়।
এই বিবৃতি এসেছে সেই সময়, যখন ফেসবুক, এক্স (পূর্বের টুইটার) এবং বিভিন্ন অনলাইন ফোরামে একটি ডিজিটালভাবে তৈরি পতাকার ছবি ভাইরাল হয়ে পড়ে। উক্ত ছবিতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ডিজাইনে ইসলামি চাঁদ ও তারা যোগ করার প্রস্তাব উল্লেখ করা হয়, যা পাকিস্তান ও তুরস্কের জাতীয় প্রতীকের সাথে মিল রাখে। প্রেস উইং জানিয়েছে, এই কল্পিত পতাকার ছবিটি ভুয়া এবং এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে।
প্রেস উইং-এর ফ্যাক্টচেক পেজে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, “বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে, বিশেষ করে এক্স-এ এই মিথ্যা প্রচারণা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে পতাকা পরিবর্তনের চিন্তাভাবনা করছে, যা সম্পূর্ণরূপে বিভ্রান্তিকর ও ভিত্তিহীন। এটি সামাজিক বিভ্রান্তি ও বিভাজন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয়েছে।”
এই ভুয়া প্রচারণার সাথে জড়িত হিসেবে যে নামটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত, তিনি হলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে এই ভুয়া প্রতিবেদন ও ছবি শেয়ার করা হয়, যার ফলে বিষয়টি মুহূর্তের মধ্যেই নজর কাড়ে দেশি-বিদেশি বহু দর্শকের।
প্রেস উইং-এর বিবৃতিতে বলা হয়, “যে ডিজাইন শেয়ার করা হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে কল্পিত। এতে পাকিস্তান, তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের দর্শকরা বিশেষভাবে সাড়া দিয়েছেন, যা প্রমাণ করে এটি পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশের বাস্তবতা বা রাষ্ট্রীয় নীতির সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।”
একইসঙ্গে দেশের নিরপেক্ষ ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্ম ‘দ্য ডিসেন্ট’ প্রকাশ করে যে, সজীব ওয়াজেদ জয় যে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই দাবি করেছেন, সেটি মূলত একটি এআই-প্রস্তুত প্রতিবেদন যার শিরোনাম ছিল “বাংলাদেশ তার পতাকায় পাকিস্তান ও তুরস্কের অনুকরণে ইসলামি চাঁদ যোগ করার কথা ভাবছে।” উক্ত প্রতিবেদনটি ৬ জুন প্রকাশিত হয় ‘রবার্ট ব্রাউন’ নামে এক কাল্পনিক লেখকের নাম ব্যবহার করে। প্রতিবেদনে কোনো তথ্যসূত্র, প্রমাণ বা স্বীকৃত উৎস উল্লেখ করা হয়নি।
ফ্যাক্টচেক অনুসারে, এই ভুয়া প্রচারণার মূল উৎস হতে পারে একটি পাকিস্তানপন্থী এক্স অ্যাকাউন্ট @SouthAsiaIndex, যেখান থেকে গত ৪ জুন একটি কল্পিত পতাকার ছবি পোস্ট করা হয়। এই একই ছবি পরে সজীব ওয়াজেদের শেয়ার করা প্রতিবেদনে ব্যবহৃত হয়।
প্রেস উইং জানিয়েছে, “এই প্রচার পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করে জাতীয়তাবাদী ও রক্ষণশীল শ্রোতাদের মধ্যে উত্তেজনা ও বিভ্রান্তি তৈরির উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। বাংলাদেশে এমন কোনো আলোচনাই হয়নি যেখানে পতাকা পরিবর্তনের প্রশ্ন উঠেছে। এ ধরনের দাবি একেবারেই অসার ও গুজব নির্ভর।”
এছাড়া, অতীতেও এমন প্রচার চালানো হয়েছে। প্রেস উইং জানিয়েছে, ২০২৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কিছু সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট যেমন @AsianDigest মিথ্যাভাবে দাবি করেছিল যে ছাত্রনেতারা নতুন জাতীয় পতাকার প্রস্তাব দিয়েছে। ওই পোস্টটি ৯০ হাজারের বেশি ভিউ পায়, তবে তা পরে যাচাই করে ভুল প্রমাণিত হয়।
এই ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে প্রেস উইং দেশবাসী এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তারা যেন এ ধরনের তথ্য শেয়ার করার আগে অবশ্যই তার সত্যতা যাচাই করেন। প্রেস উইং তাদের বিবৃতিতে আরও যোগ করে, “আমরা চাই না যে কোনো বিভ্রান্তিকর তথ্য ভিত্তিহীনভাবে জাতিকে বিভক্ত করুক। জাতীয় প্রতীক নিয়ে কল্পিত প্রচার-প্রচারণা অনভিপ্রেত এবং এর নিন্দা জানাই।”
তারা বলেন, “বাংলাদেশে জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের পক্ষে কোনো দাবি, আন্দোলন বা পরিকল্পনা রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত হয়নি। এসব কল্পিত প্রতিবেদন কেবল বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং সমাজে বিভেদ বাড়ায়। আমরা চাই তথ্য হোক সত্য, এবং জাতীয় ঐক্য অটুট থাকুক।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “চলুন আমরা সত্য তথ্যকে প্রাধান্য দিই এবং ভিত্তিহীন গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকি। জাতীয় পতাকা দেশের সার্বভৌমত্ব, ত্যাগ এবং পরিচয়ের প্রতীক — এর সঙ্গে খেলাচ্ছলে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারে অংশগ্রহণ জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।”
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভুয়া তথ্য তৈরি ও ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এধরনের ঘটনা সরকার, মিডিয়া এবং নাগরিকদের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
জাতীয় পতাকা কোনো একক সরকারের সম্পত্তি নয়, এটি একটি জাতির অস্তিত্ব ও গৌরবের প্রতীক। সুতরাং, এ নিয়ে কোনো ধরনের গুজব বা অসত্য প্রচার সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করে বিভ্রান্তি তৈরি করার প্রয়াস সংবেদনশীলতার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।
এই প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম, ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান, এবং সাধারণ ব্যবহারকারীদের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দায়িত্বশীল তথ্য যাচাই ছাড়া কোনো কিছু শেয়ার বা প্রচার করা যেমন ক্ষতিকর, তেমনি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকেও হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে।
সবশেষে প্রেস উইং আবারও স্পষ্ট করে জানায় যে, বাংলাদেশ সরকার জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের কোনো ধরনের চিন্তা, পরিকল্পনা বা আলোচনায় নেই। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের যথাযথ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তথ্য যাচাই করে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
সূত্র: বাসস