​জাতীয় ঐক্যের দৃষ্টান্ত হোক জুলাই ঘোষণাপত্র

আপলোড সময় : ১৫-০৬-২০২৫ ০৩:৪৬:৫১ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ১৫-০৬-২০২৫ ০৪:২৯:৫৫ অপরাহ্ন

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ও জাতীয় প্রেসক্লাবের করিডোর যেন গত শনিবার বিকেলটা এক বিরল রাজনৈতিক বৈঠকের জন্য চেনা পথে হাঁটল না। ‘জুলাই ঘোষণাপত্র প্রস্তাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভা ঘিরে জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তন পরিণত হয়েছিল দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক বাস্তবতার এক বিকল্প কাঠামো নির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দুতে। আয়োজক নেক্সাস ডিফেন্স অ্যান্ড জাস্টিস (এনডিজে)। অংশ নেন রাজনৈতিক নেতা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক, আইনজীবী, সাংবাদিক, ছাত্রনেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘জুলাই বিপ্লব’কে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হলে তার একটি আনুষ্ঠানিক ও সাংবিধানিক রূপরেখা থাকা প্রয়োজন—এমন ঘোষণাপত্র, যা শুধুমাত্র কোনো দলীয় স্বার্থে নয়, বরং জাতীয় স্বার্থে গৃহীত হবে। বক্তারা দাবি করেন, ঘোষণাপত্রটি যেন কোনো রাজনৈতিক দলের একক কর্মসূচি হিসেবে বিবেচিত না হয়। এটি হতে হবে রাষ্ট্র সংস্কারের সর্বজনীন মানচিত্র।

আলোচনার কেন্দ্রীয় বক্তব্যটি ছুঁয়ে যায় বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা। বলা হয়, দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামো শুধু বিপন্ন নয়, বরং এক ধরনের ছদ্ম-গণতন্ত্রে পরিণত হয়েছে, যার পেছনে কাজ করছে সাংবিধানিক ফাঁকফোকর এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধ ব্যবহারের এক দীর্ঘপ্রথা। বক্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, যদি এখনই একটি নিরপেক্ষ, আইনগত ও রাজনৈতিক রূপরেখা নির্ধারণ না করা হয়, তবে ভবিষ্যতে কোনো সরকার এ আন্দোলনকে দমনমূলক নীতিতে ব্যাখ্যা করে ফেলবে।

সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান। সভাপতিত্ব করেন এনডিজের সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান নাসির। বক্তব্যে তিনি বলেন, “জুলাই বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্র ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক রূপান্তর। কিন্তু আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেই বিপ্লব অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। আমাদের স্বৈরাচার আমলে ঘটে যাওয়া গুম, হত্যা, নিপীড়নের বিচার হয়নি। সেই বিচার ছাড়া কোনো ভবিষ্যৎ রাজনীতি টেকসই হতে পারে না।”

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মো. হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, “আজ এমন একটি আবহ তৈরি করা হচ্ছে যেন নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। অথচ নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র কল্পনাও করা যায় না। আমরা চাই নির্বাচন হোক, তবে তার আগে রাষ্ট্রের ভেতরের ফাঁকফোকর সংস্কার করতে হবে। আওয়ামী লীগের বিচারও করতে হবে। সেই সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যেও যেন অনৈক্য না থাকে।”

জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফ উদ্দীন মাহাদী বলেন, “জুলাই ঘোষণাপত্র আমাদের জাতীয় স্বার্থে প্রণয়ন করতে হবে। যদি কেউ এটিকে শুধু একটি দলের কর্মসূচি বলে অপবাদ দেয়, তাহলে ভবিষ্যতে যে সরকার আসবে তারা এটিকে দমনমূলক কার্যক্রম হিসেবে ব্যাখ্যা করবে। তখন কেউ বাঁচবে না।”

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দরকার একটি সংবিধানিক চুক্তি। যেখানে সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, তরুণ প্রজন্ম ও আন্দোলনকারীরা বসে ঠিক করবে বাংলাদেশের আগামী পথ কী হবে।’ তার এ আহ্বান ঘিরে মিলনায়তনে উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক সমর্থনের প্রতিধ্বনি ওঠে।

ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী রাফে সালমান রিফাত বলেন, “জুলাই গণ-অভ্যুত্থান একটি অসম্পূর্ণ বিপ্লব। এই বিপ্লবকে চূড়ান্ত করতে হলে একটি প্রক্লেমেশনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে।” তিনি দাবি করেন, বর্তমান রাজনৈতিক ব্যর্থতার পেছনে দায়ী রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহারকে চিহ্নিত করে শুদ্ধির আহ্বান জানানো ছাড়া উপায় নেই।

আলোচনায় সাবেক সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান বলেন, “বিপ্লব এখনও অসমাপ্ত। শেখ হাসিনার আমলে গণতন্ত্রকে রূপান্তর করা হয়েছে একটি আয়নাঘরে, যেখানে সব প্রতিচ্ছবি বিকৃত। এই আয়নাঘর ভাঙতে হবে। জনগণের প্রতারণা ঠেকাতে এমন সংবিধান দরকার যা ক্ষমতার চূড়ান্ত মালিক জনগণকে বানাবে—কাগজে নয়, বাস্তবে।”

সভা সঞ্চালনা করেন কর্নেল (অব.) জাকারিয়া হোসেন। বক্তব্য রাখেন আরও অনেকে, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদী, নিউ নেশনের সাবেক সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার, পত্রিকা ‘জবানের’ সম্পাদক রেজাউল করিম রনি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, সম্মিলিত নারী প্রয়াসের সেক্রেটারি ফেরদৌস আরা খানম এবং আইনজীবী শাহ মোহাম্মদ মাহফুজুল হক।

সভায় স্পষ্টতই রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রূপরেখা তৈরির আহ্বান উঠে আসে। বক্তারা মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতি আজ একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রতিটি ভুল সিদ্ধান্ত দেশের গণতন্ত্রকে আরও একধাপ পিছিয়ে দিতে পারে। তাই জুলাই ঘোষণাপত্র হতে পারে সেই অনন্য দলিল, যা আগামী দিনের বাংলাদেশ গঠনে একটি রাজনৈতিক চুক্তির ভিত্তি স্থাপন করবে।

আলোচনায় বিভিন্ন বক্তার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়, আগামী দিনে একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও দায়িত্বশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে সংবিধান সংস্কার, বিচারব্যবস্থা পুনর্গঠন, গুম-খুনের বিচার, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা বাহিনীর জবাবদিহিতা এবং সর্বোপরি একটি জাতীয় ঐকমত্য অপরিহার্য। জুলাই ঘোষণাপত্র তাই একক দলীয় কর্মসূচি নয়, বরং এটি হতে হবে জনগণের দাবির প্রতিচ্ছবি।

এ আলোচনা সভার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, আগামী কয়েক সপ্তাহ কিংবা মাসের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এই ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ স্থান করে নিতে পারে। তবে বাস্তবায়নের পথ সহজ নয়—প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, পারস্পরিক আস্থা এবং নেতৃত্বের সাহস।
সভা শেষে মিলনায়তনের বাইরে বের হয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের কেউ কেউ আলোচনা করেন, এটি কি তবে তৃতীয় শক্তির উত্থানের আভাস? না কি বিদ্যমান কাঠামোতেই এক নতুন রাজনৈতিক সহাবস্থানের সূত্রপাত? এর উত্তর সময়ই দেবে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—জুলাই ঘোষণাপত্র এখন আর শুধুমাত্র প্রস্তাব নয়, এটি হয়ে উঠেছে একটি বিকল্প ভাবনার সাংবিধানিক খসড়া, যেখানে কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘জনগণ’।
 

সম্পাদকীয় :

সম্পাদক ও প্রকাশক : শামীম আহমেদ


অফিস :

অফিস : গুলফেশা প্লাজা (১০ম তলা), বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭

ইমেইল : info@shomoybhela.com

মোবাইল : +880 1335-149005