​ক্ষমতায় গেলে ড. ইউনূসকে রাষ্ট্রগঠনে পাশে চায় বিএনপি

আপলোড সময় : ১৪-০৬-২০২৫ ০৬:৩২:৪২ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ১৪-০৬-২০২৫ ০৬:৩২:৪২ অপরাহ্ন

লন্ডনের চুপচাপ সন্ধ্যায় চ্যাথাম হাউসের পর্দার আড়ালে শুরু হয়েছিল একটি বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠক। সময় ছিল প্রায় দেড় ঘণ্টা, দুই প্রান্তের দুই প্রধান মুখ—প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আলোচনার পরিধি ছিল ব্যাপক, তবে এর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক রূপরেখা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি। আর এই একান্ত বৈঠকের ফাঁকে বিএনপি জানিয়ে দিয়েছে—যদি তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে, তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তারা জাতীয় পরামর্শদাতা হিসেবেই নয়, একজন দিকনির্দেশক হিসেবে সঙ্গে পেতে চায়।

বৈঠক শেষে যখন সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি ফাঁস হয়, তখন দেশের রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, তারা এখন এমন এক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক রূপকল্প তৈরি করছেন, যেখানে রাজনৈতিক পক্ষপাত নয় বরং জাতীয় স্বার্থই হবে মুখ্য। এর পেছনে অন্যতম বড় ভূমিকা রাখতে পারেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা যদি আগামী নির্বাচনে জনগণের রায়ে ক্ষমতায় আসি, তবে দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং গণতান্ত্রিক অনুশাসনের শক্ত ভিত তৈরির জন্য ইউনূস সাহেবের মতামত, অভিজ্ঞতা এবং আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা কাজে লাগাতে চাই।’ তার এই বক্তব্যে দলটির ভবিষ্যৎ প্রশাসনিক দর্শনের এক পরোক্ষ প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে।

বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, বিচারিক প্রক্রিয়া হবে দ্রুত, স্বচ্ছ এবং সকল রাজনৈতিক পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য। বিগত সময়ে বিএনপি যে সর্বাধিক রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই দলটি বিচারিক সংস্কারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘বিচার নিয়ে খেলাফ করলে জাতি আমাদের ক্ষমা করবে না। তাই আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ—দ্রুত এবং নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করবো।’

একই বৈঠকে নির্বাচনকালীন সময় নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। সূত্র বলছে, বিএনপি ডিসেম্বরের পরিবর্তে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেয়। আর এই প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টার দিক থেকে ‘ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া’ পাওয়া গেছে বলেই জানান বৈঠকসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির মধ্যেও। সদস্যদের মধ্যে সর্বসম্মতভাবে তারেক রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রস্তাবটি নিয়ে সরাসরি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করার জন্য।

তবে শুধুই কি নির্বাচন? সেই এক ঘণ্টা পঁচিশ মিনিটে কী এমন কথোপকথন হলো, যা দেশের সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ দর্শন বদলে দিল? বৈঠক-পরবর্তী একটি মন্তব্যে ইঙ্গিত মিলেছে। বিএনপির পররাষ্ট্র-বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এই আলোচনা ছিল অত্যন্ত আন্তরিক ও ফলপ্রসূ। আমরা আলোচনা করেছি কীভাবে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়েই ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায়। দেশের জন্য একটি উদার, গণতান্ত্রিক, এবং গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য।’

এই বৈঠকের পটভূমি ছিল আরও জটিল। কারণ, একই সময়ে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছিল। দাবি করা হয়েছিল নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এবং তথ্য উপদেষ্টা মুনতাসীর কামালের পদত্যাগ। যদিও তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে অন্তত একজন বিতর্কিত উপদেষ্টাকে দেখা গেছে, সেই আলোচনা পরোক্ষভাবে আরও কিছু বার্তা দিয়ে গেছে। হাফিজউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা এখনো চাই তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগ। বিষয়টি সরকারের কোর্টে রয়েছে। বল এখন তাদের দিকেই।’

সালাহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ‘এই সরকার অন্তর্বর্তী হলেও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা তাদের দায়িত্ব। যদি তারা সেটি না পারে, তাহলে জাতি তাদের বিশ্বাস হারাবে।’ এর অর্থ দাঁড়ায়, বিএনপি এখনো কঠোর অবস্থানে থেকেও সংলাপ ও সমঝোতার পথে হেঁটেছে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং এর পরবর্তী সুশাসন নিশ্চিত করতে দলটি এখন বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিচ্ছে।

এদিকে, বৈঠকের পরপরই একাধিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ড. ইউনূসের একটি পুরোনো মন্তব্য। যেখানে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে তিনি কোনো দায়িত্ব নিতে চান না। তিনি বরং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবেশ নিশ্চিত করতেই বেশি আগ্রহী। এই বক্তব্যকে অনেকেই তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার প্রয়াস হিসেবে দেখছেন। তবে বৈঠকে তারেক রহমান ড. ইউনূসের এই অবস্থানকে সম্মান জানিয়ে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় কাজে তাঁর পরামর্শ প্রয়োজন হবে, দায়িত্ব নয়। আমরা তাঁকে পাশে চাইবো একজন অভিভাবক হিসেবে, নিয়ন্ত্রক হিসেবে নয়।’

এই মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক পরিসর এক দোলাচলের মধ্যে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পর দেশ এখন একটি মৌলিক পরিবর্তনের অপেক্ষায়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, গণআন্দোলনের ঢেউ এবং বিচার ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে চলছে চুলচেরা বিতর্ক। এই পটভূমিতে বিএনপির এমন অবস্থান এবং ড. ইউনূসকে ঘিরে ভবিষ্যতের যে ভাবনা তারা তুলে ধরেছে, সেটি এক ধরনের কৌশলী রাজনীতি—যা বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখে এগোতে চায়।

বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও দ্বিধান্বিত। কেউ বলছেন, এটি কেবল একটি রাজনৈতিক কৌশল, যার মাধ্যমে বিএনপি আন্তর্জাতিক মহলে একটি উদার ও গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চায়। অন্যরা বলছেন, সত্যিই হয়তো দলটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জাতীয় ঐক্যভিত্তিক প্রশাসনের রূপরেখা তৈরির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

এই বৈঠক একটি বার্তা স্পষ্ট করে দিয়েছে—রাজনীতি এখন আর শুধু এককেন্দ্রিক শক্তির প্রদর্শনী নয়, বরং জাতীয় স্বার্থে অনেক পক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবে আগামী দিনের রাষ্ট্রচিত্র। আর সেই রাষ্ট্রচিত্রে বিএনপি তাদের ভবিষ্যৎ সরকারে নোবেল বিজয়ী ইউনূসকে একজন মেধাবী পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখতে চায়। তিনি সরকারের অংশ না হলেও, সরকারকে পথ দেখানোয় থাকবে তাঁর উপস্থিতি—এই বার্তাই যেন উঠে এলো তারেক-ইউনূস বৈঠকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইঙ্গিতে।

একজন তরুণ ভোটারের কাছে এই বার্তা কতটা প্রাসঙ্গিক? হয়তো অনেকটাই। কারণ, রাজনীতির দুর্বোধ্য সমীকরণের বাইরে এসে জাতীয় ব্যক্তিত্বদের যুক্ত করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি গঠনের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। এ এক নতুন রাজনীতির সূচনা, যেখানে যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকবে সবচেয়ে বড় মাপকাঠি।
তবে প্রশ্ন এখনো থেকেই যায়—এই বক্তব্য শুধুই কি কৌশল? নাকি সত্যিই একটি নতুন রাষ্ট্রদর্শনের সূচনা ঘটতে যাচ্ছে? সময়ই হয়তো দেবে সেই উত্তর। কিন্তু আপাতত ড. ইউনূস এবং বিএনপির এই সমীকরণে দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে যুক্ত হয়েছে এক নতুন মাত্রা—যেখানে ক্ষমতা নয়, বরং ‘পরামর্শ’ এবং ‘সহযোগিতা’র মডেল হয়ে উঠছে আগামীর রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রবিন্দু।
 

সম্পাদকীয় :

সম্পাদক ও প্রকাশক : শামীম আহমেদ


অফিস :

অফিস : গুলফেশা প্লাজা (১০ম তলা), বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭

ইমেইল : info@shomoybhela.com

মোবাইল : +880 1335-149005