
চার দিনের যুক্তরাজ্য সফর শেষে শনিবার সকালে দেশে ফিরেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে তিনি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ছিলেন সরকারি সফরের অংশ হিসেবে যাওয়া উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য ও ব্যক্তিগত সহকারীদল। হিমশীতল ব্রিটিশ আবহাওয়ায় চার দিন অবস্থান শেষে দেশে ফিরলেও এই সফরের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অভিঘাত নিয়ে দেশে ফিরে এখনো আলোচনা চলছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে।
অধ্যাপক ইউনূসের এই সফরটি ছিল রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার এই সফরের সময়কালেই যুক্তরাজ্যের রাজা তৃতীয় চার্লস তাঁকে ‘কিং চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’-এ ভূষিত করেন, যা তার সামাজিক ও মানবিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। পাশাপাশি, এই সফরের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে তার বৈঠক। দীর্ঘ সময় পর এই দুই আলোচিত ব্যক্তির মুখোমুখি আলোচনা রাজনৈতিক মহলে জোর গুঞ্জনের জন্ম দিয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, এই বৈঠকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মপন্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বৈঠকটি অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং উভয়পক্ষ একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সম্মত হয়েছেন। বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস উল্লেখ করেন, প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে আগামী ২০২৬ সালের রমজান শুরুর আগেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে তিনি স্পষ্ট করে দেন, এই পথচলা সহজ হবে না—দুর্নীতির বিচার, প্রশাসনিক সংস্কার এবং অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ ছাড়া জনগণের আস্থা অর্জন অসম্ভব হবে।
এই সফরে আরেকটি আলোচিত ইস্যু ছিল বিদেশে পাচার হওয়া অর্থের পুনরুদ্ধার। সফরের পূর্বেই অধ্যাপক ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছিলেন, প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়ে গেছে গত এক দশকে, যার একটি বড় অংশ যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর হয়েছে। এই অর্থ পুনরুদ্ধারে যুক্তরাজ্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে এবং কিছু সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেও দাবি করা হয়। এমন এক সময় এই আলোচনা হয়, যখন শেখ হাসিনার শাসনামলের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের যুক্তরাজ্যস্থ সম্পদ জব্দের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসে। এই প্রক্রিয়াকে বাংলাদেশ সরকারের দুর্নীতি বিরোধী লড়াইয়ের একটি বাস্তবিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন অনেকেই। তবে আওয়ামী লীগপন্থী মহলে এই সফরকে অপ্রাসঙ্গিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবেও দেখা হচ্ছে, যার কারণে এই সফর নিয়ে দলটির একাধিক নেতা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাজ্য সফরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের স্পিকার, লেবার পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ এবং ডায়াসপোরা কমিউনিটির সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়। সেখানে তিনি বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, অর্থনৈতিক সংকট ও মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরেন। অনেকেই এই সফরকে একটি ‘অফেনসিভ কূটনৈতিক পদক্ষেপ’ বলেও অভিহিত করেছেন। কারণ, সফরের প্রতিটি মিটিংয়ে অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। এসব বৈঠকে তিনি বিদেশি সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন বলে বিশ্লেষকদের দাবি।
অধ্যাপক ইউনূস এমন এক সময়ে যুক্তরাজ্য সফরে যান, যখন দেশজুড়ে নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকা নিয়ে চলছে বিতর্ক। বিএনপির পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানানো হলেও আওয়ামী লীগ সেই প্রস্তাব নাকচ করে আসছিল। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠনের পর এই সফর অনেক কিছু বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। একদিকে বিএনপির সঙ্গে সরাসরি আলোচনা, অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ—এই দুই কৌশল একইসঙ্গে বাস্তবায়ন করেছেন অধ্যাপক ইউনূস।
তবে এই সফরকে ঘিরে বেশ কিছু সমালোচনাও উঠেছে। অনেকেই মনে করছেন, নির্বাচনের সময় এগিয়ে এলেও প্রধান উপদেষ্টা এখনো একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতি নমনীয়তা দেখাচ্ছেন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা বারবার অভিযোগ করে আসছেন যে, অধ্যাপক ইউনূস অতীতে সরকারবিরোধী শক্তিকে সমর্থন করেছেন। এমনকি তার নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি এবং গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়েও নানা সময় রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে তার দায়িত্ব পালন এবং বিদেশ সফরে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক নতুন বিতর্কের জন্ম দিতে পারে।
তবে অধ্যাপক ইউনূস এই সফরে নিজের অবস্থান যথেষ্ট পরিস্কার করেছেন বলেই তার ঘনিষ্ঠজনেরা দাবি করেন। লন্ডনে বসবাসরত একজন বাঙালি সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই সফর কেবল আনুষ্ঠানিক সফর ছিল না। এটি ছিল একটি সিগন্যাল—বিশ্ববাসীকে জানানো যে, বাংলাদেশ এখন পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ড. ইউনূস এবং তারেক রহমানের বৈঠক স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এর রাজনৈতিক প্রভাব আগামী কয়েক মাসে দৃশ্যমান হবে।’
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গেও একাধিক অনুষ্ঠান করেছেন অধ্যাপক ইউনূস। এসব অনুষ্ঠানে তিনি ভবিষ্যৎ উন্নয়ন কৌশল, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক উদ্যোগ বিষয়ে আলোচনা করেন। তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে একটি বক্তৃতায় তিনি বলেন, “আমরা যে বাংলাদেশ চাই, সেটি গড়ে তোলা সম্ভব যদি আমাদের মধ্যে উদ্ভাবন, সহানুভূতি ও দৃঢ়তা থাকে।” এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোড়ন তোলে এবং অনেকেই তাকে ‘ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়ক’ হিসেবেও উল্লেখ করেন।
এই সফরের আরেকটি আকর্ষণীয় দিক ছিল কিং চার্লসের সঙ্গে একান্ত বৈঠক এবং সম্মাননা গ্রহণ। এটি অধ্যাপক ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সহায়ক হয়েছে বলে কূটনৈতিক মহলের অভিমত। আগে থেকেই তিনি বিশ্বব্যাপী নোবেলজয়ী একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তবে এই সফর তার নতুন রাজনৈতিক পরিচয়কে আরও দৃঢ়তা দিয়েছে।
ঢাকায় ফেরার পর তাকে স্বাগত জানান সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও কিছু রাজনৈতিক নেতা। বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক কথা না বললেও, তার কার্যালয় থেকে জানানো হয়, আগামী সপ্তাহে তিনি বিস্তারিত ব্রিফিং করবেন। এই ব্রিফিংয়ে তিনি সফরের মূল উদ্দেশ্য, অর্জন এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনা তুলে ধরবেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, এই সফরের প্রভাব ইতোমধ্যেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পড়তে শুরু করেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই সফরের বিশ্লেষণ প্রকাশ হচ্ছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ মনে করছেন, এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, কেউ কেউ আবার এই সফরকে 'রাজনৈতিক নাটক' বলেও অভিহিত করেছেন।
তবে সন্দেহ নেই যে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তার এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী রাজনীতিতে একটি দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যেভাবে তিনি দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ মহলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করছেন, তা আগামী নির্বাচন ও সরকারের রূপকাঠামোর ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
একই সঙ্গে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি যে সংকেত দিয়েছেন, তাও জনগণের কাছে ইতিবাচক বার্তা হিসেবে গৃহীত হচ্ছে। এখন দেখার বিষয় হলো, এই সফরের বাস্তব প্রভাব কতটুকু হয়, এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে তিনি কতটা নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন।
এই সফরের পর অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর দেশের মানুষ এবং আন্তর্জাতিক মহলের নজর এখন অনেক বেশি। এই দৃষ্টিভঙ্গি সামনে রেখে তিনি কীভাবে আগামী সময়টাকে ব্যবস্থাপনা করেন, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
সফর শেষ, কিন্তু অধ্যাপক ইউনূসের ‘বাংলাদেশ সংস্কার’ এখনও অনেকটাই বাকি!
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ছিলেন সরকারি সফরের অংশ হিসেবে যাওয়া উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য ও ব্যক্তিগত সহকারীদল। হিমশীতল ব্রিটিশ আবহাওয়ায় চার দিন অবস্থান শেষে দেশে ফিরলেও এই সফরের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অভিঘাত নিয়ে দেশে ফিরে এখনো আলোচনা চলছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে।
অধ্যাপক ইউনূসের এই সফরটি ছিল রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার এই সফরের সময়কালেই যুক্তরাজ্যের রাজা তৃতীয় চার্লস তাঁকে ‘কিং চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’-এ ভূষিত করেন, যা তার সামাজিক ও মানবিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। পাশাপাশি, এই সফরের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে তার বৈঠক। দীর্ঘ সময় পর এই দুই আলোচিত ব্যক্তির মুখোমুখি আলোচনা রাজনৈতিক মহলে জোর গুঞ্জনের জন্ম দিয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, এই বৈঠকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মপন্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বৈঠকটি অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং উভয়পক্ষ একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সম্মত হয়েছেন। বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস উল্লেখ করেন, প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে আগামী ২০২৬ সালের রমজান শুরুর আগেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে তিনি স্পষ্ট করে দেন, এই পথচলা সহজ হবে না—দুর্নীতির বিচার, প্রশাসনিক সংস্কার এবং অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ ছাড়া জনগণের আস্থা অর্জন অসম্ভব হবে।
এই সফরে আরেকটি আলোচিত ইস্যু ছিল বিদেশে পাচার হওয়া অর্থের পুনরুদ্ধার। সফরের পূর্বেই অধ্যাপক ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছিলেন, প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়ে গেছে গত এক দশকে, যার একটি বড় অংশ যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর হয়েছে। এই অর্থ পুনরুদ্ধারে যুক্তরাজ্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে এবং কিছু সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেও দাবি করা হয়। এমন এক সময় এই আলোচনা হয়, যখন শেখ হাসিনার শাসনামলের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের যুক্তরাজ্যস্থ সম্পদ জব্দের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসে। এই প্রক্রিয়াকে বাংলাদেশ সরকারের দুর্নীতি বিরোধী লড়াইয়ের একটি বাস্তবিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন অনেকেই। তবে আওয়ামী লীগপন্থী মহলে এই সফরকে অপ্রাসঙ্গিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবেও দেখা হচ্ছে, যার কারণে এই সফর নিয়ে দলটির একাধিক নেতা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাজ্য সফরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের স্পিকার, লেবার পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ এবং ডায়াসপোরা কমিউনিটির সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়। সেখানে তিনি বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, অর্থনৈতিক সংকট ও মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরেন। অনেকেই এই সফরকে একটি ‘অফেনসিভ কূটনৈতিক পদক্ষেপ’ বলেও অভিহিত করেছেন। কারণ, সফরের প্রতিটি মিটিংয়ে অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। এসব বৈঠকে তিনি বিদেশি সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন বলে বিশ্লেষকদের দাবি।
অধ্যাপক ইউনূস এমন এক সময়ে যুক্তরাজ্য সফরে যান, যখন দেশজুড়ে নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকা নিয়ে চলছে বিতর্ক। বিএনপির পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানানো হলেও আওয়ামী লীগ সেই প্রস্তাব নাকচ করে আসছিল। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠনের পর এই সফর অনেক কিছু বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। একদিকে বিএনপির সঙ্গে সরাসরি আলোচনা, অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ—এই দুই কৌশল একইসঙ্গে বাস্তবায়ন করেছেন অধ্যাপক ইউনূস।
তবে এই সফরকে ঘিরে বেশ কিছু সমালোচনাও উঠেছে। অনেকেই মনে করছেন, নির্বাচনের সময় এগিয়ে এলেও প্রধান উপদেষ্টা এখনো একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতি নমনীয়তা দেখাচ্ছেন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা বারবার অভিযোগ করে আসছেন যে, অধ্যাপক ইউনূস অতীতে সরকারবিরোধী শক্তিকে সমর্থন করেছেন। এমনকি তার নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি এবং গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়েও নানা সময় রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে তার দায়িত্ব পালন এবং বিদেশ সফরে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক নতুন বিতর্কের জন্ম দিতে পারে।
তবে অধ্যাপক ইউনূস এই সফরে নিজের অবস্থান যথেষ্ট পরিস্কার করেছেন বলেই তার ঘনিষ্ঠজনেরা দাবি করেন। লন্ডনে বসবাসরত একজন বাঙালি সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই সফর কেবল আনুষ্ঠানিক সফর ছিল না। এটি ছিল একটি সিগন্যাল—বিশ্ববাসীকে জানানো যে, বাংলাদেশ এখন পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ড. ইউনূস এবং তারেক রহমানের বৈঠক স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এর রাজনৈতিক প্রভাব আগামী কয়েক মাসে দৃশ্যমান হবে।’
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গেও একাধিক অনুষ্ঠান করেছেন অধ্যাপক ইউনূস। এসব অনুষ্ঠানে তিনি ভবিষ্যৎ উন্নয়ন কৌশল, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক উদ্যোগ বিষয়ে আলোচনা করেন। তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে একটি বক্তৃতায় তিনি বলেন, “আমরা যে বাংলাদেশ চাই, সেটি গড়ে তোলা সম্ভব যদি আমাদের মধ্যে উদ্ভাবন, সহানুভূতি ও দৃঢ়তা থাকে।” এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোড়ন তোলে এবং অনেকেই তাকে ‘ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়ক’ হিসেবেও উল্লেখ করেন।
এই সফরের আরেকটি আকর্ষণীয় দিক ছিল কিং চার্লসের সঙ্গে একান্ত বৈঠক এবং সম্মাননা গ্রহণ। এটি অধ্যাপক ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সহায়ক হয়েছে বলে কূটনৈতিক মহলের অভিমত। আগে থেকেই তিনি বিশ্বব্যাপী নোবেলজয়ী একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তবে এই সফর তার নতুন রাজনৈতিক পরিচয়কে আরও দৃঢ়তা দিয়েছে।
ঢাকায় ফেরার পর তাকে স্বাগত জানান সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও কিছু রাজনৈতিক নেতা। বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক কথা না বললেও, তার কার্যালয় থেকে জানানো হয়, আগামী সপ্তাহে তিনি বিস্তারিত ব্রিফিং করবেন। এই ব্রিফিংয়ে তিনি সফরের মূল উদ্দেশ্য, অর্জন এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনা তুলে ধরবেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, এই সফরের প্রভাব ইতোমধ্যেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পড়তে শুরু করেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই সফরের বিশ্লেষণ প্রকাশ হচ্ছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ মনে করছেন, এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, কেউ কেউ আবার এই সফরকে 'রাজনৈতিক নাটক' বলেও অভিহিত করেছেন।
তবে সন্দেহ নেই যে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তার এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী রাজনীতিতে একটি দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যেভাবে তিনি দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ মহলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করছেন, তা আগামী নির্বাচন ও সরকারের রূপকাঠামোর ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
একই সঙ্গে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি যে সংকেত দিয়েছেন, তাও জনগণের কাছে ইতিবাচক বার্তা হিসেবে গৃহীত হচ্ছে। এখন দেখার বিষয় হলো, এই সফরের বাস্তব প্রভাব কতটুকু হয়, এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে তিনি কতটা নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন।
এই সফরের পর অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর দেশের মানুষ এবং আন্তর্জাতিক মহলের নজর এখন অনেক বেশি। এই দৃষ্টিভঙ্গি সামনে রেখে তিনি কীভাবে আগামী সময়টাকে ব্যবস্থাপনা করেন, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
সফর শেষ, কিন্তু অধ্যাপক ইউনূসের ‘বাংলাদেশ সংস্কার’ এখনও অনেকটাই বাকি!